

পোড়ামাটির ভাস্কর্য, ফলক নির্মাণ বাংলা তথা ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন কাল থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয় এ সম্পর্কিত করণ-কৌশল, পদ্ধতি নিয়ে বেদ বা বেদপূর্ব শাস্ত্রকারগণ বিস্তারিত কিছু লিখে রেখে যাননি। ফলক নির্মাণপদ্ধতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ আজ অবধি বাংলা ভাষাতেও পাওয়া যায়নি। তবে কিছ পুরাণ, ইতিহাসাশ্রয়ী গ্রন্থ ও চিকিৎসাশাস্ত্রীয় সংকলন পোড়ামাটির মূর্তি নির্মাণ বিষয়ক পদ্ধতি ও কৌশল যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
বাংলায় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে স্থাপত্যেও গাত্রালঙ্কার হিসেবে পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহার শুরু হয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ মহাস্থানগড়ে অবস্থিত বাসু বিহার, গোবিন্দ ভিটা, পলাশ বাড়ি, ট্যাংরা প্রভৃতি প্রত্নস্থানে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পোড়ামাটির ফলক প্রস্তুত করতে মৃৎশিল্পীগণ সম্ভবত তাদের সমকালে বিশেষ ধরণের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। যে জন্য এখন পর্যন্ত পোড়ামাটির ভাস্কর্যসমৃদ্ধ স্থাপত্যসমূহ এদেশের জল-হাওয়ায় নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছে।
প্রাচীন বাংলার স্থপতিগণ প্রস্তর ভাস্কর্য তক্ষণে অসাধারণ দক্ষতা দেখালেও উপাদানজনিত কারণে স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্রে বর্ণিত নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা হিসেবে পোড়া ইটের মাধ্যমে উঁচুশীর্ষ রেখ দেউল নির্মাণ করতে গিয়ে বার বার গণ্ডির কাছে ভেঙ্গে যেতে দেখেছেন। পোড়া ইট দিয়ে অভ্রভেদি চূড়ার কোনো দেব-দেউল নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাংলার স্থপতি তথা ভাস্কর ফিরে গেছেন মৃত্তিকার কাছে। তার ভাবাবেগের সাথে যুক্ত হয়েছে শিল্পমনস্বিতা। পরবর্তী সময়ে নতুন নতুন স্থাপত্যরীতির উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন তারা, সংযোজন করেছেন নতুন নতুন স্থাপত্য কৌশল।
বাংলায় ( পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা) মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে বাঙালি স্থপতিগণও তাই স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার যে নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস ভারতের সর্বত্র অনুসৃত হয়েছে সেই রীতিকে রক্ষা করার জন্য নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পোড়ামাটির ফলক ও মূর্তি নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। পোড়া ইটের ভবনগাত্রকে বৈচিত্র্যময় পোড়ামাটির ফলক দিয়ে অলঙ্কৃত করাকেই সাজুজ্যপূর্ণ বলে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছিলেন পরম্পরার মৃৎভাস্করগণ। পোড়া ইটের উপাসনালয়কে পোড়ামাটির ফলক দিয়েই সজ্জিত করার শিল্পপদ্ধতি বাঙালি মৃৎশিল্পীর ব্যাপক ও গভীর মনস্বীরই পরিচায়ক।