Thursday, 19 November 2015

বাংলার মৃৎশিল্পের ইতিহাস ২


বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বহু বছর ধরেই মৃৎশিল্পের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ । তবে তাদের মধ্যে কুমারটুলি, মঙ্গলকোট,কৃষ্ণনগর ,দত্তপুকুর বিখ্যাত।
কুমারটুলি (কথ্য উচ্চারণে কুমোরটুলি) উত্তর কলকাতায় অবস্থিত একটি অঞ্চল এই অঞ্চলটিপটুয়া-পাড়াবা মৃৎশিল্পীদের বসতি অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত
কুমারটুলি অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের দক্ষতার কথা সর্বজনবিদিত। কলকাতার এই অঞ্চল থেকে দেবদেবীর প্রতিমা কেবলমাত্র শহরের সর্বজনীন ঘরোয়া পূজার জন্যই সরবরাহ করা হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেশের বাইরেও রপ্তানি করা হয়। কুমারটুলি পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত হস্তশিল্প (মৃৎশিল্প) কেন্দ্রও বটে
ইতিহাস অনুযায়ী, ইংরেজরা কোম্পানির মজুরদের জন্য পৃথক পৃথক অঞ্চল ভাগ করে, এইভাবে কলকাতার দেশীয়দের অঞ্চলগুলি বিভিন্ন পেশাভিত্তিক পাড়ায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই শুঁড়িপাড়া, কলুটোলা, ছুতার-পাড়া, আহিরীটোলা কুমারটুলি প্রভৃতি অঞ্চলের উৎপত্তি ঘটে। ঊন-বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বড়বাজার অঞ্চলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে উত্তর কলকাতার মৃৎশিল্পীরা শহর ছেড়ে চলে যান। কিন্তু কুমারটুলির পটুয়ারা, যারা গঙ্গা-মাটি সংগ্রহ করে মাটির পাত্র ইত্যাদি তৈরি করে সুতানুটি বাজারে (এখন বড়বাজার) বিক্রি করতেন, তাঁরা টিকে যান। পরবর্তীকালে তাঁরা ধনী সম্প্রদায়ের বাড়ির পূজার নিমিত্ত দেবদেবীর প্রতিমা নির্মাণ করতে শুরু করেন কলকাতা বাইরে বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজার প্রচলন হলে পূজা-কমিটিগুলি কুমারটুলি থেকে প্রতিমা সংগ্রহ করতে থাকেন

মঙ্গলকোট  পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমাধীন কুনুর নদীর ডান তীরে অবস্থিত এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল অজয় নদের সঙ্গে কুনুর নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত এর ধ্বংসাবশেষ বিস্তৃত

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৬-৯০ সালের মধ্যে এই প্রত্নস্থলটিতে উৎখনন কার্য পরিচালনা করে
মঙ্গলকোটে পাঁচটি প্রধান সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম স্তরে তাম্র-প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে কালো লাল রঙের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মৃৎপাত্রের সন্ধান মিলেছে। অন্যান্য নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে লাল মৃৎপাত্রের টুকরা বা ফালি; সঙ্গে তামাটে, কমলা, গাঢ় বাদামি এবং দীপ্তিমান লোহিত মৃন্ময়। তবে কালো মসৃণ অমসৃণ মৃৎপাত্রের টুকরার সংখ্যাই অধিক। কিছু মাটির পাত্র সাদা বা কালো রঙের চিত্র দ্বারা অলঙ্কৃত। রেডিওকার্বন পদ্ধতির ভিত্তিতে পর্বের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রথম দ্বিতীয় স্তরের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মৃৎশিল্প জাতীয় নিদর্শন হিসেবে লাল, বাদামি, ধূসর কালো রঙের সাধারণ মানের মৃৎপাত্রের টুকরা; কালো লাল রঙের অপকৃষ্ট শ্রেণির মৃৎপাত্রের টুকরা এবং পূর্ববর্তী স্তরের মৃৎপাত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় স্তরের প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে লৌহ নির্মিত বিপুল সংখ্যক তীরের অগ্রভাগ, বাটালি ছুরির ফলা ইত্যাদি। সামগ্রীগুলি থেকে লোহা ব্যবহারের ক্রমবৃদ্ধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য সময় হাড়ের সামগ্রী ব্যবহারেরও প্রচলন ছিল।
একদিকে কালো লাল মৃৎপাত্রের অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে কয়েক ধরনের নতুন মৃৎশিল্পের উদ্ভব তৃতীয় সাংস্কৃতিক স্তরকে (মৌর্য-শূঙ্গ আমল: আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১ম খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষ পর্যন্ত) বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। নতুন মৃৎ সামগ্রীর মধ্যে নকশাবিহীন নকশাঙ্কিত উভয় প্রকারের লাল, ধূসর কালো মৃৎপাত্রের টুকরা এবং উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্রের (Northern Black Polished Ware) অপকৃষ্ট ধরনের অল্প কিছু নমুনা রয়েছে। স্তরের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে একটি ছাপাঙ্কিত তাম্র মুদ্রা, লেখবিহীন তাম্র মুদ্রা এবং মৌর্য-শূঙ্গ শিল্পরীতির বেশ কিছু পোড়া মাটির মূর্তি। চতুর্থ স্তরটি কুষাণ সাংস্কৃতিক পর্বের একটি সমৃদ্ধিসূচক সময়কে তুলে ধরে। স্তরে মঙ্গলকোট প্রত্নস্থলে সম্ভবত সর্বপ্রথম ইটের রৈখিক বা লম্বালম্বি কাঠামো দৃষ্টিগোচর হয়। ফুল জ্যামিতিক অলঙ্করণের সুস্পষ্ট ছাপ সম্বলিত শক্ত লাল মৃৎপাত্র হচ্ছে যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক মৃৎ-সামগ্রী। পর্বের প্রাপ্ত আকর্ষণীয় প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে বেশ কিছু সিলমোহর, নির্ধারিত ছাঁচে নির্মিত পোড়ামাটির মূর্তি (কোন কোন মূর্তি স্বচ্ছ বস্ত্র পরিহিত) রয়েছে। হাতে গড়া পুরুষ মহিলা উভয়েরই বেশ কিছু মূর্তি এই স্তরে পাওয়া যায়। পঞ্চম স্তরটি গুপ্তদের সমসাময়িক এবং একটি সমৃদ্ধ বস্ত্তগত জীবনের চিত্র তুলে ধরে। পূর্ববর্তী সময়ের মতো পর্বেও ব্যাপক নির্মাণ কর্মকান্ড দেখা যায়। লালচে বাদামি রঙের অলঙ্কৃত পাতলা মৃৎসামগ্রী যুগের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে। স্তরে নানা ধরনের প্রতীক সম্বলিত বহুসংখ্যক সিল পাওয়া গেছে।

No comments:

Post a Comment