Saturday, 24 October 2015

বাংলায় পোড়ামাটি




মাটি প্রকৃতির উপাদানমানুষের উদ্ভাবন সৃজন প্রক্রিয়ার অন্যতম বিকাশ মৃৎশিল্পএই তত্ত্বের প্রমাণ মেলে বিশ্বের প্রধান সভ্যতাসমূহের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় পাওয়া মৃৎশিল্পের নিদর্শনসমূহে মাটির অন্যতম প্রধান উপাদান জলীয় পদার্থ নিয়মিত তাপ দিয়ে অনার্দ্রকরণ নমনীয়তা দূর করে যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটানো হলো, তার ফলেই বিকাশ হলো মৃৎশিল্পেরপ্রত্নতত্ত্ববিদ নৃতত্ত্ববিদদের মতে মানব সমাজের প্রথম বা আদি মৃৎশিল্পী নারীকৃষকের ঘরের মেয়েরা এই মৃৎশিল্প নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করেসমাজবিজ্ঞানীদের মতে অনুকূল প্রাকৃতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবেশে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ধারায় চাকে গড়া, হাতে ছাঁচে গড়া মৃৎশিল্পের বিকাশ ঘটেছেমিশরে সর্বপ্রথম প্রায় তিন হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৃৎশিল্পীর চাকা আবিস্কৃত হয়আদিকালের মৃৎশিল্প স্বাভাবতই প্রথমে কৃষিপূর্ব যুগের ঝুড়ি, নানা রকমের বল্কলপাত্র, কাঠপাত্র, পাথরপাত্রের অনুকরণে গড়ে উঠেপরে ধীরে ধীরে উপাদানের ব্যবহার প্রয়োগরীতির ক্রমোন্নতির ফলে মৃৎশিল্পের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়কৃষি প্রধান অর্থনীতির দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ক্রমোন্নতির ফলে মৃৎশিল্পের আঙ্গিক, নক্সা কারুকুশলতারও উন্নতি হয় এবং মৃৎশিল্প বংশগত পারদর্শিতানির্ভর বিশিষ্ট কারুশিল্পে পরিণত হয়বিশেষ ধরণের মাটি, উচ্চতর কৌশল দক্ষতা দিয়ে এই মৃন্ময় সৌন্দর্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে পোড়ামাটির ফলক দুভাবে তৈরি হতো- কাঁদামাটি থেকে সরাসরি হাতে তৈরি এবং ছাঁচের সাহায্যেমূল ফলকগুলোর ভেতরের নতোন্নত ভাস্কর্যসমূহ হাতে কুঁদে রূপায়ণ করতেন প্রথম কুলিক বা প্রধান স্থপতি (পাল রাজসভায় প্রথম কুলিকের সম্মানজনক আসন নির্ধারিত ছিল বলে ইতিহাস পাঠে জানা যায়) দক্ষ মৃৎভাস্করগণপরবর্তী ধাপের শিল্পীরা স্থাপত্যের গাত্রালঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত অজস্র ফলক আগে থেকে প্রস্তুত চমৎকার কারুকাজ করা ছাঁচে ফেলে তৈরি করতেন
পোড়ামাটির ভাস্কর্য, ফলক নির্মাণ বাংলা তথা ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন কাল থেকেই চর্চিত হয়ে আসছেকিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয় সম্পর্কিত করণ-কৌশল, পদ্ধতি নিয়ে বেদ বা বেদপূর্ব শাস্ত্রকারগণ বিস্তারিত কিছু লিখে রেখে যাননি ফলক নির্মাণপদ্ধতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ আজ অবধি বাংলা ভাষাতেও পাওয়া যায়নিতবে কিছ পুরাণ, ইতিহাসাশ্রয়ী গ্রন্থ চিকিৎসাশাস্ত্রীয় সংকলন পোড়ামাটির মূর্তি নির্মাণ বিষয়ক পদ্ধতি কৌশল যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে লিপিবদ্ধ করে গেছেন
বাংলায় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে স্থাপত্যেও গাত্রালঙ্কার হিসেবে পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহার শুরু হয়েছে দেখতে পাওয়া যায়উদাহরণ স্বরূপ মহাস্থানগড়ে অবস্থিত বাসু বিহার, গোবিন্দ ভিটা, পলাশ বাড়ি, ট্যাংরা প্রভৃতি প্রত্নস্থানে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারেপোড়ামাটির ফলক প্রস্তুত করতে মৃৎশিল্পীগণ সম্ভবত তাদের সমকালে বিশেষ ধরণের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করতেনযে জন্য এখন পর্যন্ত পোড়ামাটির ভাস্কর্যসমৃদ্ধ স্থাপত্যসমূহ এদেশের জল-হাওয়ায় নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছে
প্রাচীন বাংলার স্থপতিগণ প্রস্তর ভাস্কর্য তক্ষণে অসাধারণ দক্ষতা দেখালেও উপাদানজনিত কারণে স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্রে বর্ণিত নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা হিসেবে পোড়া ইটের মাধ্যমে উঁচুশীর্ষ রেখ দেউল নির্মাণ করতে গিয়ে বার বার গণ্ডির কাছে ভেঙ্গে যেতে দেখেছেনপোড়া ইট দিয়ে অভ্রভেদি চূড়ার কোনো দেব-দেউল নির্মাণ করা সম্ভব হয়নিএই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাংলার স্থপতি তথা ভাস্কর ফিরে গেছেন মৃত্তিকার কাছেতার ভাবাবেগের সাথে যুক্ত হয়েছে শিল্পমনস্বিতাপরবর্তী সময়ে নতুন নতুন স্থাপত্যরীতির উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন তারা, সংযোজন করেছেন নতুন নতুন স্থাপত্য কৌশল
বাংলায় ( পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা) মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে বাঙালি স্থপতিগণও তাই স্থাপত্য ভাস্কর্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার যে নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস ভারতের সর্বত্র অনুসৃত হয়েছে সেই রীতিকে রক্ষা করার জন্য নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পোড়ামাটির ফলক মূর্তি নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিলেনপোড়া ইটের ভবনগাত্রকে বৈচিত্র্যময় পোড়ামাটির ফলক দিয়ে অলঙ্কৃত করাকেই সাজুজ্যপূর্ণ বলে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছিলেন পরম্পরার মৃৎভাস্করগণপোড়া ইটের উপাসনালয়কে পোড়ামাটির ফলক দিয়েই সজ্জিত করার শিল্পপদ্ধতি বাঙালি মৃৎশিল্পীর ব্যাপক গভীর মনস্বীরই পরিচায়ক

No comments:

Post a Comment