Thursday, 19 November 2015

নির্মিতি বৈশিষ্ট্য গুপ্ত ও পাল যুগের আগে



লোকায়ত শিল্পের প্রধান মৌলিক বৈশিষ্ট্য- প্রত্যক্ষ দৈনন্দিন জীবনের বস্তুময়তা, সাবলিলতা ও প্রাণময়তা। গুপ্ত ও পাল যুগের পূর্বসুরী মৃৎশিল্পীরা যেন তাদের সমস্ত লোকায়ত উপাদান নিয়ে নব পর্যায়ের এই মৃৎশিল্পীদের সৃষ্টিতে নব আঙ্গিকে প্রবলভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। মঙ্গলকাব্যে, বারোমাস্যায়, মহাকাব্যের লৌকিক রূপায়ণে,নানা গাথাগীতিকায়, পদাবলীতে দেশ ও জাতির মর্মকথা প্রকাশিত হয়। এই লোক সাহিত্যের সমান্তরালে লৌকিক শিল্পেরও বিকাশ ঘটে। এই লৌকিক শিল্পের প্রয়োগ হয়েছে বাংলার (এখানে বাংলা বলতে উভয় বাংলা) গ্রামে গ্রামে নির্মিত ইটের তৈরি মন্দিরের গায়ে অগণিত সুপক্ক মৃৎফলকে।
পোড়ামাটিশিল্পের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে পোড়ামাটির ফলক সজ্জিত স্থাপত্য অর্থাৎ ধর্মীয় সৌধের গঠনশৈলীর বিষয়টি অবধারিতভাবে আলোচনায় চলে আসে। এখানে বাংলাদেশের উপাসনালয়ের স্থাপত্যশৈলীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হলো।এর ফলে স্থাপত্যের গায়ে পোড়ামাটির ফলকসজ্জার কৌশলগত দিকটি উদ্ভাসিত হবে।
“…
পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বা ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত নির্মিত এই মন্দিরগুলোতে যে রুচি ও আদর্শের সন্ধান পাওয়া যায় তার মূল সূরটি সেই প্রাচীনকালের। কিন্তু প্রয়োগ পদ্ধতি ও প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণ অন্যরকম। রূপকল্পনায়, গঠনকৌশল, রীতিপ্রকরণে এবং অলংকরণের আঙ্গিক বিন্যাসে ও বিষয়বস্তুতে এই মন্দির অলংকরণ দ্বাদশ শতক অবধি প্রচলিত বাংলার শিল্প ও স্থাপত্যের ধারা থেকে অনেকখানেই পৃথক। পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ঊনিবিংশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত এই মন্দির নির্মাণ প্রচেষ্টাকে তাই নব পর্যায়ের মন্দির চর্চা বলে উল্লেখ করতে পারি।
নবপর্যায়ের মন্দির চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল গ্রামে। প্রতিষ্ঠাতা ও স্থপতি দুজনই গ্রামের জীবনধারায় সম্পৃক্ত ছিলেন। এই মন্দিরগুলো বৃত্তি ও জাতি নির্বিশেষে গ্রামীণ জনসাধারণের জীবন-সাধনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ, তাদের রুচি, চিন্তা ও কর্মের ফসল।
পালযুগ থেকে বাঙালির আঞ্চলিক সত্ত্বা ক্রমশ গড়ে উঠছিল। তবে পাল সেন আমলের মন্দির শিল্পকলার সাথে নবপর্যায়ের মন্দির শিল্পকলার প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। বাংলার প্রাচীন মন্দির সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই কম, কেননা প্রত্বতাত্ত্বিক নিদর্শন খুবই অপ্রতুল । প্রায় সবই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। মাত্র কয়েকটি বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে অঙ্কিত চিত্র ও কতগুলো প্রস্তর মূর্তিতে উৎকীর্ণ মন্দিরের প্রতিকৃতি থেকে আমরা প্রাচীন বাংলার মন্দিরসমূহের গঠনরীতি সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারি।
বাংলাদেশের বাগেরহাটের কোদলা মঠ’ (আনু:১৭শ শতক), ফরিদপুরের মথুরাপুর দেউল, বরিশালের মাহিলারার সরকারের মঠ
মাহিলারার সরকারের মঠ
পরবর্তীকালে নির্মিত মুন্সীগঞ্জের সোনারং মঠ
রেখ-দেউল নির্মাণের পূর্ব বঙ্গীয় উদাহরণ হিসেবে ধরে নিতে পারি। রেখ-দেউল স্থাপত্যরীতিটি বাঙালি মনীষার নিজস্ব সৃষ্টি নয়; ওড়িশার আঞ্চলিক রূপ অনুসরণ করে এই মন্দির-নির্মাণ পদ্ধাতিটির প্রচলন করা হয়েছিল বাংলায়, কিন্তু পর্যাপ্ত পাথরের অভাবে এটির রীতি-প্রকৃতি এদেশে অনেকাংশে বদলে যায়। উপযুক্ত উপকরণের অভাবে অর্থাৎ প্রয়োজনীয় গুণাগুণসম্পন্ন পাথরের অপ্রতুলতাই এর কারণ।
বিকল্প উপকরণ হিসেবে স্থপতি পোড়ামটির ইট ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তাতে আশানুরূপ ফল হয়নি, স্থপতি তার চোখের সামনেই দেখেছেন গণ্ডীর মাথা বার বার ভেঙে পড়তে। তখন স্বভাবতই তাকে চিন্তিত করেছে যে, কিভাবে এই ভঙ্গুরতা কাটিয়ে উঠে ভঙ্গুর উপকরণের সাহায্যে মন্দিরের স্থায়িত্ব বিধান করা যায়।
পোড়ামাটির স্থায়িত্ব ও ভার বহন ক্ষমতা যেহেতু গ্রানাইট প্রভৃতি পাথরের তুলনায় কম, তাই বাংলাদেশের মন্দির স্থাপত্যে ব্যবহৃত উপকরণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন মন্দির বা দেউল নির্মাণ করতে সিদ্ধান্তে আসতে বিলম্ব হলেও অবশেষে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে বাঙালি স্থপতিগণ। এ ভাবেই অবশেষে বাংলা অঞ্চলের স্থপতিগণ নিজস্ব মন্দির স্থাপত্যশৈলীর উদ্ভাবন করেন।
বাংলার এই সনাতন শিল্পীগোষ্ঠী একাধারে কাষ্ঠ, পাষাণ, মৃত্তিকা ও চিত্র’-এই চারটি মাধ্যমেই কাজ করত। সূত্রধরনামের মধ্যেই তাবিধৃত। তাই কাঠ, খড়, বাঁশ ইত্যাদি উপকরণ থেকে ইট বা পাথরের উপকরণে উপনীত হতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হতে হয়নি।

No comments:

Post a Comment