Saturday, 19 September 2015

বাংলার মৃৎশিল্পের ইতিহাস ১



বাংলার পোড়ামাটি এবং চন্দ্রকেতুগড়



চন্দ্রকেতুগড় বাংলার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । বাংলার ২৪ পরগনাএবং কোলকাতা শহর থেকে উত্তরপূর্ব দিকে একদা ভাগীরথি নদীর শাখা নদী বিদ্যাধরী নদীর কূল ঘেঁষে এর অবস্থান। এই অঞ্চলে একাধিকবার খনন করা হয়েছে। খননে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাচীনত্ব ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব প্রমাণ করে। এখানকার নিদর্শনাবলির প্রধান অংশ কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু নিদর্শন শহর এবং শহরের বাইরে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রয়েছে।
প্রত্নস্থলটিতে বর্তমানে দেবালয়, হাদীপুর, বেড়াচাঁপা, শানপুকুর, ঝিক্‌রা ও ইটাখোলা গ্রামের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। মাটির তৈরি বিশালদুর্গ প্রাচীর প্রত্নস্থলটির মূল কেন্দ্র ঘিরে আছে; আকৃতিতে আয়তাকার এবং মোটামুটিভাবে এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। মাটির তৈরি এ দুর্গপ্রাচীরের অভ্যন্তরেই চন্দ্রকেতুগড়, খনা মিহিরের ঢিবি, ইটাখোলা এবং নুনগোলা ইত্যাদি স্থানে খননের মাধ্যমে পাঁচটি পৃথক সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে।


প্রথম পর্বটি প্রাক্‌-উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্রপর্যায়ের স্তরকে নির্দেশ করে। দ্বিতীয় পর্বটি ৪০০ থেকে ১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালের। এই স্তরে লম্বা গলার লাল মৃৎপাত্র; কানাবিহীন বড় গোলাকার পেয়ালা ও বাটি; কালো, সোনালি এবং বেগুনী রং-এর উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র; ধূসর রং-এর সাধারণ মৃৎপাত্রের টুকরা; তামার তৈরি চোখে সুরমা লাগাবার দণ্ড ; ও হাতির দাঁতের সামগ্রীর খণ্ড; ছাপাঙ্কিত তাম্র মুদ্রা; লিপিবিহীন ছাঁচে ঢালা তাম্র মুদ্রা; এবং বেশ কিছু পোড়ামাটির সামগ্রী যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পুঁতি, নামাঙ্কিত সীল ও সীলমোহর রয়েছে। তৃতীয় স্তরটি কুষাণ যুগের সমসাময়িক এবং স্তরটি আপাতদৃষ্টিতে সমৃদ্ধ। এ স্তর হতে রোমক রুলেটেড’ (নকশা করা) পাত্রের অংশ বিশেষ; কালো অথবা অনুজ্জল লাল রং-এরঅ্যামফোরাবা গ্রিস দেশীয় মৃৎপাত্রের বেশ কিছু ভাঙ্গা অংশ; ছাপাঙ্কিত নকশাযুক্ত মনোরম লোহিত মৃন্ময়; ধূসর মৃৎপাত্র; এবং নিখুঁতভাবে ছাঁচে তৈরি পোড়ামাটির ক্ষুদ্র মূর্তি পাওয়া গেছে। এ পর্বকে খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতাব্দীর মধ্যে ধরা হয়। চতুর্থ স্তরটিকে গুপ্ত এবং গুপ্তোত্তর যুগের বলে চিহ্নিত করা হয়। এ স্তরের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে সীল ও সীলমোহর; পোড়া মাটির সামগ্রী; ছাপাঙ্কিত নকশাযুক্ত ও ছাঁচে নির্মিত মৃৎপাত্র। এ স্তরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হচ্ছে ১৪ ফুটের বেশি উচুঁসর্বত-ভদ্ররীতির ইট নির্মিত বিশাল একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। কোন বিশেষ দেব-দেবীর সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায় ধর্মীয় এমন কোন নমুনা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া যায়নি। তবে, গুপ্ত স্তর থেকে সূর্য্য দেবতার প্রতিকৃতি একটি বেলে পাথর ফলকের নিম্নাংশে পাওয়া গেছে। পঞ্চম স্তরের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ খুবই কম, এগুলি সম্ভবত পাল যুগের বলে ধরে নেওয়া হয়। শিল্প নিদর্শনের ভিত্তিতে সুস্পষ্ট যে, মৌর্য থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত এ প্রত্নস্থলের প্রধান শিল্প মাধ্যম ছিল ছাঁচ নির্মিত পোড়ামাটির সামগ্রী। সার্বিক বিবেচনায় এ শিল্পটি শিল্পরীতিতে ৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে গাঙ্গেয় ভারতের শিল্পকলার নিদর্শনাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে হয়। এগুলির বিস্ময়কর বিষয় বৈচিত্র্য এই অঞ্চলের শিল্পরীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করেছে। এখানে ধর্মীয় ও আচার সংক্রান্ত নিদর্শনাবলি যা পাওয়া গেছে তার মধ্যে আদিম ধরিত্রি-দেবী, যক্ষ, যক্ষিণী, নাগ, পুরুষ বা নারী মুর্তি, কখনও পশুচালিত যানে দণ্ডায়মান এবং পাখাযুক্ত দেব-দেবী রয়েছে। আবার ধর্মের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই এমন বস্তুও পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির সামগ্রীতে বিশেষ করে পোশাক অথবা শারিরীক সাধারণ বৈশিষ্ট খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতাব্দীর গ্রেকো-রোমান যোগাযোগের গভীর প্রভাব দেখা যায়। প্রেমবিলাসী কামার্ত যুগলের কিংবামৈথুনভঙ্গিতে চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নস্থল থেকে অগণিত পোড়া মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। অলঙ্কারযুক্ত পুরুষ ও নারী মূর্তিসমূহ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে স্বর্ণকারের শিল্পের অনুকরণ করা হতো।


বর্তমানে প্রত্নস্থলটি সুনিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এমন বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, চন্দ্রকেতুগড়ই সম্ভবত পেরিপ্লাসএবং টলেমী সূত্রে উল্লিখিত প্রাচীন গাঙ্গেবা গঙ্গারিডাই।বাংলার পোড়ামাটি শিল্পের ইতিহাসের ক্ষেত্রে চন্দ্রকেতুগড়ের ভূমিকা অনস্বীকা‍‌র্য।




3 comments: